বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীরউত্তম: গতকাল ছিল মহান ভাষা দিবস। ১৯৪৮ সাল থেকে শুরু করে ’৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ছিল ভাষা আন্দোলনের সফল পরিণতি। মূলত ভাষা আন্দোলনেই ছিল স্বাধীনতার বীজ। পাকিস্তানের সময় ২১ ফেব্রুয়ারি বা ৮ ফাল্গুন যে গুরুত্ব ভালোবাসা ও হৃদয়ের অর্ঘ্য দিয়ে পালন করা হতো এখন আর তা হয় না। নব্বইয়ের দশক পর্যন্ত ২১ ফেব্রুয়ারিতে একটা প্রাণের তাগিদ ছিল। সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার ভাষা আন্দোলনের বীর শহীদদের প্রতি বুকফাটা দরদ ও ভালোবাসা ছিল। কিন্তু এখন আর তেমন নেই। আস্তে আস্তে সবকিছু ফিকে হতে চলেছে। গতকাল টাঙ্গাইলে ছিলাম। সকাল সাড়ে ৯টার দিকে বিএনপির কয়েকজনকে মিছিল করে যেতে দেখলাম। একপর্যায়ে তারা খালেদা জিয়ার মুক্তি ও আরও কিছু দলীয় সেøাগান দিয়ে নাচতে নাচতে গেল। কেন যেন মনে হচ্ছিল এই একটা পবিত্র দিনকে দলীয় দৃষ্টিকোণ থেকে না দেখলে চলত না! সত্যিই আমরা যেন কেমন হয়ে গেছি। পরম করুণাময় আল্লাহ ভাষাশহীদদের বেহেশতবাসী করুন। বেশ কিছুদিন আগে এক সন্ধ্যায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানের ধানমন্ডির বাড়ি গিয়েছিলাম। হাতে ছিল ফরিদের লেখা ‘বঙ্গবীরের ভারতে নির্বাসনের দিনগুলি’। কথার এক ফাঁকে ফরিদ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে বইটি দিতেই ভীষণ উৎসাহ নিয়ে তিনি বললেন, ‘বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকীতে আমরাও একটা বই করেছি।’ এই বলে ‘নেতা মোদের শেখ মুজিব’ নামে ৫১৬ পৃষ্ঠার গ্লোসি কাগজে ছাপা, ১ কেজি ৮০০ গ্রাম ওজনের ১১/৮.৫ ইঞ্চি সাইজের চমৎকার একটি বই আমার হাতে তুলে দিলেন। বইটি দেখতে খুবই সুন্দর। ওজনও অনেক। উঁচু করতে হাত ব্যথা করে। বইটি নিয়ে বেশ কদিন নাড়াচাড়া করেছি। একদিক থেকে দেখলে খুবই ভালো হয়েছে, অন্যদিকে কিছু সমালোচনাও আছে। যেমন ৪৬৫-৪৭২ পৃষ্ঠা দুবার বাঁধানো হয়েছে। তথ্যসূত্র ৪০টি। একই লেখকের তিন-চারটি বইয়ের কথাও আছে। মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে খুব কম গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে, কাদেরিয়া বাহিনীর নামগন্ধও নেই। অথচ কাদেরিয়া বাহিনী ছিল সব দিক থেকে সুসংগঠিত। কাদেরিয়া বাহিনী যেভাবে আনুষ্ঠানিকতার সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর কাছে সর্বপ্রথম অস্ত্র জমা দিয়েছে তেমন আর কেউ কোথাও দেয়নি। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মুক্ত স্বাধীন দেশের মাটিতে পা রেখেছিলেন ১০ জানুয়ারি ১৯৭২। এর মাত্র ১৪ দিনের দিন ২৪ জানুয়ারি আমরা আমাদের সমস্ত অস্ত্র তাঁর পায়ের কাছে বিছিয়ে দিয়েছিলাম। ৩১ জানুয়ারি ১৯৭২ মুজিব বাহিনীর পক্ষ থেকে পল্টন ময়দানে শেখ ফজলুল হক মণির নেতৃত্বে বঙ্গবন্ধুর হাতে কিছু অস্ত্র তুলে দেওয়া হয়েছিল। আর কোথাও মুক্তিবাহিনীর অস্ত্র আনুষ্ঠানিকভাবে জমা দেওয়া হয়নি। কেউ পাকিস্তানের অনুগত থানায়, কেউ আবার ভারতীয় সেনা ক্যাম্পে অস্ত্র দিয়েছেন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ইতিহাসের পাতায় একটা বিরাট জায়গা নিয়ে থাকলেও মুক্তিযুদ্ধের পর মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা করা, অস্ত্র জমা নেওয়া, তাদের যথাযথ সম্মান ও সুযোগ-সুবিধার কোনোটাই ঠিকভাবে করা হয়নি। সত্যিই বঙ্গবন্ধু যদি ফিরে না আসতেন দেশের কী যে হতো বলা যায় না। আল্লাহ মেহেরবান বঙ্গবন্ধু সশরীরে ফিরে এসেছিলেন। যেভাবেই হোক মারামারি কাটাকাটি ছাড়াই আমরা একটা শান্তিপূর্ণ অবস্থায় ফিরে এসেছিলাম। তখনো কমবেশি সহনশীলতা ছিল। এখন তো দেশ একেবারেই ভাগ হয়ে গেছে। তখনো পাকিস্তান সমর্থক ছিল, স্বাধীনতাবিরোধী ছিল, এখনো আছে। এখনো দলাদলি কাটাকাটি শেষ হয়নি। তখন সবার মধ্যেই কমবেশি দেশপ্রেম ছিল। এখন আস্তে আস্তে সেই দেশপ্রেমও শেষ হতে চলেছে। ঠিক এই সময় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানের সম্পাদনায় মওলা ব্রাদার্সের ৫১৬ পৃষ্ঠার ‘নেতা মোদের শেখ মুজিব’ বিশাল বইটি একটা জাতীয় সম্পদ হতে পারে। সম্পাদনা পরিষদও বেশ বড়সড়। প্রকাশক আহমেদ মাহমুদুল হক। প্রকাশকের কথায় তিনি বইটির বিষয়বস্তুর অনেকটাই সার্থকভাবে তুলে ধরেছেন। সম্পাদনা পরিষদে আছেন- অধ্যাপক ড. খন্দকার বজলুল হক, মাহবুব উদ্দিন আহমদ বীরপ্রতীক, অধ্যাপক ড. নাসরীন আহমদ, এন আই খান, মেজর জেনারেল মো. মুজিবুর রহমান, ড. মো. হারুনর রশীদ বিশ্বাস, সৈয়দ বেলাল হোসেন, মো. শরীফ মাহমুদ অপু। প্রধান গবেষক নাজমুল হোসেন। প্রধান নির্বাহী জার্নি। গবেষক- রাজীব দাস, সৈয়দ মিজানুর রহমান, সাফিয়া তাসনিম খান, মো. শফিকুল ইসলাম, মাহবুব এলাহী ও তাওহিদুল ইসলাম। যে কোনো কাজেই একদল মেধাবীর যখন সমন্বয় হয় তখনই একটা ভালো কাজ হয়- এ কাজটিও তার জ্বলন্ত প্রমাণ। বইটি উৎসর্গ করা হয়েছে ‘জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, কারাগারে শহীদ জাতীয় চার নেতা- সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী ও এ এইচ এম কামারুজ্জামান, ’৭৫-এর ১৫ আগস্ট সব শহীদ এবং মুক্তিযুদ্ধ ও গণতান্ত্রিক আন্দোলনে আওয়ামী লীগের নিহত সব নেতা-কর্মীসহ শহীদদের পূণ্য স্মৃতিতে।’ আসাদুজ্জামান খান এমপির সম্পাদনায় মওলা ব্রাদার্সের ‘নেতা মোদের শেখ মুজিব’ বইটি এক জাতীয় সম্পদ হয়ে থাকবে- এতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। ভাবীকালে যারাই বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে, আওয়ামী লীগকে নিয়ে লিখবেন তাদের বইটি কাজে লাগবে। বিশেষ করে মুজিব জন্মশতবর্ষের শ্রদ্ধাঞ্জলির এ বইটি হবে বাঙালি জাতির জন্য এক শ্রেষ্ঠ পুরস্কার।
‘সংগ্রামে আন্দোলনে গৌরবগাথায়’ শেখ হাসিনা এমপির লেখা দিয়ে শুরু হয়েছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর লেখাটি বেশ প্রাঞ্জল ও শক্তপোক্ত। ‘আমাদের নেতা শেখ মুজিব’ আসাদুজ্জামান খানের লেখাও বেশ চমৎকার। আসাদুজ্জামান খান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের পুরো কর্মকান্ডই তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন। জাতির পিতার শৈশব-কৈশোর-যৌবন সবকিছু আছে তার আলোকপাতে। ‘নেতা মোদের শেখ মুজিব’ লেখার চাইতে ছবির প্রাধান্য বা গুরুত্ব বেশি। বহু দুর্লভ ছবির সমন্বয় ঘটেছে বইটিতে। লেখা হিসেবে বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী, কারাগারের রোজনামচা, আমার দেখা নয়াচীন থেকে নেওয়া হয়েছে অনেক কিছু। তা ছাড়া বঙ্গবন্ধুর অনেক আলাপচারিতা, সভা-সমাবেশের ভাষণ, ভাষা আন্দোলনে তাঁর ভূমিকা এসব যথার্থই সুন্দরভাবে তুলে ধরার চেষ্টা হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর অনেক চিঠি স্থান পেয়েছে বইটিতে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং শেখ কামালের ৬৬ পৃষ্ঠায় ভাইবোনের চমৎকার ছবিটি দেখার মতো। বইটি একসময় অ্যালবাম হিসেবেই প্রতিষ্ঠা পাবে বলে আমার বিশ্বাস। ছবি কথা কয় এটা এ বইতে যথার্থই ফুটে উঠেছে। হুজুর মওলানা ভাসানী, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক এঁদের অনেক দুর্লভ ছবি রয়েছে এতে। আতাউর রহমান খান, আবুল মনসুর আহমদ, কফিল উদ্দিন চৌধুরী, মাহমুদ আলী, মশিহুর রহমান, ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী, মনোরঞ্জন ধর, গৌরচন্দ্র বালা কেউ বাদ পড়েননি। কমবেশি সবাই আছেন। শুধু স্বাধীনতা-পর্বে মুক্তিযুদ্ধে কাদেরিয়া বাহিনীর বঙ্গবন্ধুর হাতে অস্ত্র তুলে দেওয়া বাদ পড়েছে। পর্বটা ‘নেতা মোদের শেখ মুজিবে’ জায়গা পায়নি। ১৯৫৭ সালে ভারত সফরে ভারতের মহামান্য রাষ্ট্রপতি রাজেন্দ্র প্রসাদের সঙ্গে মুখ্যমন্ত্রী আতাউর রহমান খান এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দুর্লভ ছবি অনেকের মনে সাড়া জাগাবে। ’৫৭ সালে শেখ মুজিবের নেতৃত্বে সাত সদস্যের গণচীন সফরের অনেক দুর্লভ ছবি রয়েছে বইটিতে। এমনকি ১৯৫৭ সালের ৭-৮ ফেব্রুয়ারি কাগমারী মহাসম্মেলনের অসাধারণ দুর্লভ বহু ছবি স্থান পেয়েছে। ১৯৫৮ সালের এপ্রিলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সফরের চমৎকার ছবি বইটিতে আছে। আমার মনে হয় প্রেসিডেন্ট ইস্কান্দার মির্জা ও সেনাপ্রধান জেনারেল আইয়ুব খানের এমন বেসামরিক পোশাকের ছবি আর কখনো দেখিনি। কামাল, জামাল এবং মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কোলে রেহানা এক দৃষ্টিকাড়া ঐতিহাসিক ছবি। বঙ্গবন্ধুর বাতিলকৃত পাসপোর্টের ছবি বইটির মূল্য বাড়িয়ে দিয়েছে।
আমরা অনেকেই নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গির নই, আমরা প্রায় সবাই একদিগ্দর্শী। শুধু আওয়ামী লীগ। আওয়ামী লীগই সব, আর কারও কোনো অবদান নেই এমন চিন্তা থেকে ‘নেতা মোদের শেখ মুজিব’ বইটি অতি উত্তম ও অসাধারণ। কিন্তু সার্বিকভাবে দেখতে গেলে কিছু ত্রুটি-বিচ্যুতি অবশ্যই রয়ে গেছে। আর সামান্য কিছু ঘটনা অথবা আরও কিছু মানুষের অবদান বইটিতে তুলে ধরা সম্ভব হলে বইটি অসাধারণ জাতীয় সম্পদ হিসেবে স্থান পেত। বিশেষ করে আমাদের দেশে গোষ্ঠী ও দলীয় নেতা অনেক আছেন। কিন্তু জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক গুরুত্বপূর্ণ নেতা খুব বেশি নেই। আমাদের দেশে জাতীয় নেতা ছিলেন শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক, মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। শেরেবাংলা ও মওলানা ভাসানীর মতো হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী গ্রামের কৃষক-শ্রমিক সাধারণ মানুষের নেতা ছিলেন না। তিনি অনেকটাই উচ্চ শ্রেণির মানুষের নেতা ছিলেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান উঁচু-নিচু-ধনী-গরিব সবার প্রিয় নেতা হয়ে উঠেছিলেন। মহানায়ক তোফায়েল আহমেদের নেতৃত্বে ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান, ’৭০-এর সাধারণ নির্বাচন এবং ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে একমাত্র বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানই জাতীয় ও আন্তর্জাতিক নেতৃত্ব অর্জন করেছিলেন। এটা স্বীকার করতেই হবে, বর্তমানে দেশে জাতীয় নেতা দু-চার জন থাকলেও আন্তর্জাতিক স্তরে শেখ হাসিনা ছাড়া দ্বিতীয় কেউ নেই। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং ছোটবোন শেখ রেহানার ২৫ ও ৫১৫ পৃষ্ঠায় দুজনের দুটি ছবি অসাধারণ। ৫১৪ পৃষ্ঠায় গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় বঙ্গবন্ধু এবং তাঁর মা-বাবার কবরের ছবিগুলো বইটির মূল্য এবং গুরুত্ব অনেক বাড়িয়ে দিয়েছে। বনানী কবরস্থানে বঙ্গবন্ধু পরিবারের সদস্যদের এক সারিতে অনেক কবর পাঠক এবং দর্শকদের অনুভূতিতে দাগ কাটবে। বইটিতে প্রায় ৪০টি বই-পুস্তক থেকে তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে। সেখানে যেমন ভারতের স্বনামধন্য লেখিকা শ্যামলী ঘোষ আছেন, তেমনি পাকিস্তানের ‘উইটনেস টু সারেন্ডার’-এর সিদ্দিক সালিকও আছেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যখন আওয়ামী লীগের সভানেত্রী হয়ে ভারত থেকে দেশে ফেরেন সে সময় তাঁকে আওয়ামী লীগের ওপর শ্যামলী ঘোষের গবেষণাটি উপহার দিয়েছিলাম। তখন ফটোকপি বা জেরক্স করার এখনকার মতো আধুনিক যন্ত্রপাতি ছিল না। কুলায় ঝাড়ার মতো বা চালনিতে আটা ছাঁটার মতো সরিষার মতো কীসব এদিক-ওদিক করে জেরক্স করতে হতো। সেভাবেই প্রায় তিন-চার শ পৃৃষ্ঠার আওয়ামী লীগ সম্পর্কে শ্যামলী ঘোষের পিএইচডির মূল গবেষণাটি তাঁর হাতে তুলে দিয়েছিলাম। যার এক কপি এখনো আমার কাছে আছে। কিন্তু আওয়ামী লীগের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস ও নির্বাচিত দলিল প্রথম খন্ড নূহ-উল-আলম লেনিনের সময় প্রকাশনীর সূত্রটিতে খুশি হতে পারিনি। সময় পেরিয়ে গেলে আমার মতো পথ বদল হয় না।
অনেকেই হয়তো জানেন না, জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমান ’৬৯ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি আগরতলা মামলা থেকে মুক্তি পেয়েছিলেন। মামলাটি তুলে নিতে বাধ্য হয়েছিলেন আইয়ুব খান। ২৩ ফেব্রুয়ারি ’৬৯-এর গণআন্দোলনের মহানায়ক তোফায়েল আহমেদ গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ার শেখ লুৎফর রহমানের ছেলে শেখ মুজিবুর রহমানকে জাতির পক্ষ থেকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত করেছিলেন। ২৪ মার্চ পর্যন্ত আইয়ুব খান পাকিস্তানের শাসন ক্ষমতায় ছিলেন। তারপর আবার সামরিক শাসন। ১৯৫৮ সালের ২৭ অক্টোবর প্রধান সেনাপতি আইয়ুব খান যেমন প্রেসিডেন্ট ইস্কান্দার মির্জাকে লন্ডনে এক হোটেলে ম্যানেজারের চাকরি দিয়ে দেশ থেকে বের করে দিয়েছিলেন, ঠিক তেমনি উন্নয়নের দশক পালনের সময় ’৬৯ সালের ২৪ মার্চ প্রধান সেনাপতি ইয়াহিয়া খান স্বঘোষিত ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খানের কাছ থেকে ক্ষমতা কেড়ে নিয়েছিলেন। ফেব্রুয়ারির সাত দিন, মার্চের ২৪ দিন খুব সম্ভবত ৩১-৩২ দিন আবার জাঁতাকলে, আবার সামরিক শাসনের নিচে। ইয়াহিয়া খান ২৪ মার্চ সন্ধ্যায় বেতার ভাষণ দিয়েছিলেন- ‘প্রিয় দেশবাসী! আমার রাজনীতির কোনো ইচ্ছা নেই। আমি একজন প্রকৃত সৈনিক। আগামী দুই বছরের মধ্যে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধির হাতে ক্ষমতা তুলে দিয়ে ব্যারাকে ফিরে যাব।’ ইয়াহিয়া খান প্রতিশ্রুতি রাখেননি। এ রকম সময় তেমন কেউ খুব একটা প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেননি, করেনও না। মাত্র কদিন ২৩ ফেব্রুয়ারি থেকে ২৪ মার্চ যারা শোনেননি তাদের হয়তো গা-জ্বালা করে না, আমি নিজ কানে শুনেছিলাম তাই আমার গা নয়, বুক জ্বালা করে, কলিজা ছিঁড়ে যেতে চায়। তাই না বলে থাকতে পারি না। আমি যেমন বঙ্গবন্ধুর পিঠের চামড়া দিয়ে মতিয়া চৌধুরীর ডুগডুগি বাজাতে চাওয়া সহ্য করিনি, হাসানুল হক ইনুর ‘তোমরা বল শেখ মুজিব জাতির পিতা, আমি বলি জুতার ফিতা’ এমন ঔদ্ধত্যও মেনে নিতে পারিনি, ঠিক তেমনি তোফায়েল আহমেদ কর্তৃক জাতির পক্ষ থেকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধি দেওয়ার মাত্র কয়েকদিনের মধ্যে বামপন্থিদের পল্টন ময়দানের এক জনসভায় আওয়ামী লীগ-ছাত্রলীগের বঙ্গবন্ধু শিরোনামে ছাপা হ্যান্ডবিল হাতে চিৎকার করে বলেছিলেন, ‘এই যে তোফায়েল, তোদের বঙ্গবন্ধু না চঙ্গবন্ধু, তাকে আমি টুকরো টুকরো করলাম’ এই বলে তার হাতে থাকা বঙ্গবন্ধুর নামে লিফলেটগুলো টুকরো টুকরো করে মঞ্চ থেকে ছুড়ে ফেলেছিলেন। সেই কাগজের টুকরোগুলো এখনো আমার চোখে ভাসে। তার তির্যক চিৎকার ‘তোদের বঙ্গবন্ধু চঙ্গবন্ধুকে টুকরো টুকরো করলাম’ এখনো আমার বুক ফেটে যায়। সেই লেনিনের আমার বোনের নেতৃত্বে কত মর্যাদা, কত ক্ষমতা আর মহানায়ক তোফায়েল আহমেদ অবহেলিত, লতিফ সিদ্দিকী বহিষ্কৃত, আমার তো কথাই নেই। পিতার হাতে তুলে দেওয়া অস্ত্রগুলোর দাম পেলেও খেয়ে-পরে বাঁচতে পারতাম।
বইটির দাম ধরা হয়েছে ২০০০ টাকা। এটা ২০০ টাকা হলেই যথেষ্ট হতো। ২০০০ কেন, যারা ২ লাখ টাকা হলেও কিনে শোকেসে শোভাবর্ধন করতে পারবেন তাদের জন্য এ বই নয়, বঙ্গবন্ধুও নয়। বঙ্গবন্ধু যাদের জন্য তারা ২০০০ কেন, ২০০ টাকা দিয়েও কিনতে পারেন না। বেশ কিছু বছর আগে সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রগতি প্রকাশনের সুন্দর সুন্দর বই দেখা যেত। দাম ছিল পানির মতো। এ ক্ষেত্রে তেমন দৃষ্টিকোণ থেকে বইটির দাম একেবারে পানির দামে হওয়া উচিত। তবে সবকিছু বিচারে এক অসাধারণ দেখার এবং পড়ার মতো বই ‘নেতা মোদের শেখ মুজিব’। চমৎকার বইটি উপহার দেওয়ার জন্য সজ্জন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানকে আন্তরিক অভিনন্দন ও শুভ কামনা জানাচ্ছি। বইটিতে কাদেরিয়া বাহিনীর নামগন্ধ না থাকলেও ২৮৩ পৃষ্ঠায় কাদেরিয়া বাহিনীর গর্বিত যোদ্ধা আজহার, বাবুল তালুকদার, বঙ্গবন্ধুর মেজ ছেলে শেখ জামাল, জাহাঙ্গীর, বাবু; বসা অবস্থায় বজলু ও আরিফ আহমেদ দুলালের একটি অসাধারণ ছবি রয়েছে। আশা করি পরবর্তী সংস্করণে ২৪ জানুয়ারি ১৯৭২ স্বাধীন বাংলাদেশে সর্বপ্রথম বঙ্গবন্ধুর পদতলে কাদেরিয়া বাহিনীর অস্ত্র বিছিয়ে দেওয়ার বিষয়টি স্থান পাবে।
লেখক : রাজনীতিক।
www.ksjleague.com সূএ: বাংলাদেশ প্রতিদিন